বাংলাদেশের বিভিন্ন নৃগোষ্ঠীর সংস্কৃতি (পাঠ ৫)

সপ্তম শ্রেণি (মাধ্যমিক) - বাংলাদেশ ও বিশ্বপরিচয় বাংলাদেশের সংস্কৃতি ও সাংস্কৃতিক বৈচিত্র্য | - | NCTB BOOK
459
459

বাংলাদেশে বসবাসকারী বেশিরভাগ মানুষ বাঙালি। তবে এদেশে প্রায় ৫০টির কাছাকাছি ভিন্ন নৃগোষ্ঠীর মানুষও বাস করে। তাদের আচার-আচরণ, খাদ্যাভ্যাস, পোশাক-পরিচ্ছদ, আনন্দ-উৎসব এগুলো তাদের পৃথক সাংস্কৃতিক পরিচয়কে তুলে ধরে।

বাংলাদেশে নৃগোষ্ঠীর বসবাস

বাঙালির বাইরে অন্য নৃগোষ্ঠীর অধিকাংশ মানুষ বাস করে পার্বত্য চট্টগ্রাম অঞ্চলে। এ অঞ্চলে বসবাস করে চাকমা, মারমা, ত্রিপুরা, বম, খুমিসহ আরও অনেক নৃগোষ্ঠী।

বৃহত্তর ময়মনসিংহে বসবাসকারী ভিন্ন নৃগোষ্ঠী হচ্ছে গারো, হাজং। সিলেট অঞ্চলে রয়েছে খাসিয়া ও মণিপুরিদের বাস। উত্তরবঙ্গ-বিশেষ করে চাঁপাইনবাবগঞ্জ, রাজশাহী, রংপুর, দিনাজপুর অঞ্চলে বাস করে সাঁওতাল ও ওঁরাওসহ অন্যান্য অনেক সম্প্রদায়। আর কক্সবাজার ও পটুয়াখালী অঞ্চলে বাস করে রাখাইন সম্প্রদায়ের মানুষ।

ভিন্ন নৃগোষ্ঠীর সংস্কৃতি

এদেশের সকল নৃগোষ্ঠীর সংস্কৃতি ভিন্ন ভিন্ন। নিচে এদের সংস্কৃতির পরিচয় দেওয়া হলো:

ধর্ম: বিভিন্ন নৃগোষ্ঠীর মানুষ একসময় প্রকৃতি পূজা করত। প্রকৃতির প্রতি এই মমত্ববোধ ও ভক্তি এখনও তাদের মাঝে বিদ্যমান। তারা বিশ্বাস করে যে, মানুষ প্রকৃতির অধীন, প্রকৃতি মানুষের অধীন নয়। একারণেই তারা পূজা পার্বণ, সামাজিক রীতি নীতি, দৈনন্দিন জীবন যাপন সর্বত্র নানাভাবে প্রকৃতিকে রক্ষা করার গুরুত্ব তুলে ধরে। কিন্তু ধীরে ধীরে ঔপনিবেশিক শক্তির সংস্পর্শে আসার ফলে এবং আধুনিক জাতি রাষ্ট্রের আওতাভুক্ত হয়ে যাওয়ায় নৃগোষ্ঠীগুলো আধুনিক সভ্যতার ধর্ম, বিশ্বাস, রীতি নীতি, শিক্ষা, সংস্কৃতি দ্বারা প্রভাবিত হয়। অনেক সম্প্রদায় নতুন ধর্ম গ্রহণ করে। যেমন: চাকমা, মারমা, রাখাইনসহ অনেক নৃগোষ্ঠী বৌদ্ধ ধর্ম গ্রহণ করে। আবার গারো, সাঁওতাল, ওঁরাওসহ অনেক নৃগোষ্ঠী খ্রিষ্টধর্ম গ্রহণ করে। কিন্তু এরপরও চাকমা, মারমা, রাখাইন, গারো, সাঁওতাল, ওঁরাওসহ বিভিন্ন নৃগোষ্ঠীর মানুষ এখনো প্রকৃতিকে বিভিন্নভাবে তাদের জীবনে ধরে রেখেছে। যেমন: নৃগোষ্ঠীর গোত্র ব্যবস্থায় বিভিন্ন গোত্রের প্রতীক হিসেবে ব্যবহার হয় প্রকৃতির নানা উপাদান যথা, গাছ পালা, পশু-পাখি ইত্যাদি।

আনন্দ উৎসব

বাংলাদেশের প্রায় সকল নৃগোষ্ঠীর মানুষ নাচগানের মধ্য দিয়ে আনন্দ-উৎসব পালন করে থাকে। রাধা-কৃষ্ণের উদ্দেশ্যে কীর্তন ও নাচ করা মণিপুরিদের সবচেয়ে প্রিয়। একে 'গোপী নাচ' বলা হয়। বসন্তকালে তারা জাঁকজমকের সাথে হোলি উৎসব পালন করে। ওঁরাওরা ফাল্গুন মাস থেকে বছর গণনা শুরু করে। নববর্ষকে বরণ করতে তারা পালন করে ফাগুয়া। সাঁওতালরা পালন করে সোহরাই, বাহা, পাসকা পরবসহ নানা উৎসব। পার্বত্য চট্টগ্রামের ক্ষুদ্র নৃগোষ্ঠীর বৈসুক, সাংগ্রাই ও বিজু এই তিনটিকে সমন্বয় করে বর্তমানে সবাই একত্রে পালন করে 'বৈসাবি'। মারমা ও রাখাইনরা নববর্ষের উৎসবে ধুমধামের সাথে পালন করে জল উৎসব। উল্লেখ্য যে, নৃগোষ্ঠীর আনন্দ-উৎসবের অধিকাংশ এখনও ফসল উৎপাদনের সাথে সম্পৃক্ত।

লোকবিশ্বাস

পৃথিবীর অন্য সব নৃগোষ্ঠীর মতো বাংলাদেশের নৃগোষ্ঠীর মানুষের মধ্যে নানা ধরনের বিশ্বাস কাজ করে। যেমন, মণিপুরি ও অন্যান্য বৌদ্ধধর্ম অনুসারী সম্প্রদায়ের কাছে পূর্ণিমা ও অমাবস্যার রাত বিশেষ তাৎপর্যপূর্ণ। পূর্ণিমার রাতে এরা অনেক ধর্মীয় ও সাংস্কৃতিক উৎসব পালন করে থাকে। নানা সংস্কারের প্রচলন আছে তাদের মধ্যে। যেমন, ওঁরাওরা বিশ্বাস করে যে, পৌষ মাসে গৃহনির্মাণ ও ছাউনি দেওয়া অকল্যাণ। গারোদের বিশ্বাস এই যে, রাত্রে ঘর ঝাড়ু দিয়ে ময়লা বাইরে ফেলতে নেই। বর্মনরা মনে করে মাঘ মাসে মূলা খাওয়া উচিত নয়। খিয়াংরা মনে করে নবজাতক সন্তানকে ছুঁতে হলে আগুনে হাত একটু গরম করে নিতে হয়। তা না হলে শিশুর অমঙ্গল হওয়ার সম্ভাবনা থাকে।

বিয়ে

বিভিন্ন নৃগোষ্ঠী সমাজে বিয়ের আগে পাত্র-পাত্রী একে অপরের পছন্দ করার সুযোগ থাকলেও সকল প্রক্রিয়া সম্পন্ন হয় পারিবারিক ও সামাজিক নিয়মে। বেশিরভাগ নৃগোষ্ঠীরই অন্য গোত্রের মধ্যে বিয়ে না করার রীতি রয়েছে। আনুষ্ঠানিকতার পাশাপাশি বিয়ে নিয়ে রয়েছে নানা বিশ্বাস। যেমন, পাংখোয়ারা জুলাই মাসে বিয়ে করা এবং বিয়ের প্রস্তাব দেওয়াও নিষিদ্ধ মনে করে। এ সময় বিয়ে হলে বা বিয়ের সূত্রপাত হলে সংসার সুখের হয় না বলে তারা মনে করে। মাহাতোরা অগ্রহায়ণ মাসে বিয়ে করেনা। আর খাসিয়া ও গারো মাতৃসূত্রীয় সমাজে যেহেতু মায়ের কাছ থেকে কন্যা সমুদয় সম্পত্তি পাবার রীতি প্রচলিত, তাই আশা করা হয় যে, মেয়ের জামাই বাধ্যতামূলকভাবে স্ত্রীর পরিবারের সাথে বাস করবে।

পোশাক ও অলংকার

বিভিন্ন নৃগোষ্ঠীর অধিকাংশ মানুষ নিজেরাই নিজেদের পোশাক তৈরি করে থাকে। চাকমা পুরুষদের প্রধান পোশাক লুঙ্গি ও শার্ট। মেয়েরা সাধারণত নিচের অংশে লাল ও কালো রঙের পোশাক পরে থাকে। এর নাম 'পিনোন'। উপরের অংশে তারা একধরনের ব্লাউজ পরে। মারমা নারীদের পোশাককে বলে 'থামি'। ওঁরাওরা ধুতি ও শার্ট পরে। অনেক সম্প্রদায়ের মানুষ নানা ধরনের অলঙ্কার পরে থাকে। চাকমা মেয়েরা বালা, নেকলেস ও কানের দুল পরে। সাঁওতাল ও ওঁরাও মেয়েরা হাত, গলা, কান ও পায়ের আঙুলে পরে নানা ধরনের অলংকার। অতি প্রাচীনকাল থেকে ওঁরাও মহিলাদের ব্যবহৃত অলংকারগুলো হচ্ছে: কানখুলি (কানের লতিতে পরে), তিপার পাতা (কানের উপরের অংশে পরে), নোলক (নাকের সামনে পরে), নাকচনা (নাকের ফুল), হাসলি (গলায় পরে) ইত্যাদি। গারো নারীদের ঐতিহ্যগত পোশাক দকমান্দা, দকশাড়ি ইত্যাদির পাশাপাশি রয়েছে খকানিল, রিকমাচু, পেনতাসহ হরেক রকমের অলঙ্কার। অন্যান্য নৃগোষ্ঠীরও নানারকম অলংকার পরার রেওয়াজ আছে।

খাদ্য ও পানীয়

কোনো কোনো নৃগোষ্ঠীর মানুষ বিশ্বাস করে একটি নির্দিষ্ট প্রাণী হচ্ছে তাদের গোত্রের প্রতীক। এই বিশ্বাসকে টোটেম বলে। সাধারণত যেকোনো নৃগোষ্ঠীর মানুষের কাছে তাদের নিজ নিজ টোটেম খাওয়া নিষিদ্ধ। যে কোনো ধরনের নেশা জাতীয় দ্রব্য গ্রহণ কিংবা পান কিংবা মাংস ভক্ষণ রীতি মনিপুরীদের সমাজে নিষিদ্ধ। ধর্মীয় উৎসবাদিতে মাছও নিষিদ্ধ। প্রতিটি নৃগোষ্ঠীরই রয়েছে এক বা একাধিক বিশেষ পছন্দের খাবার। যেমন- 'নাখাম' অর্থাৎ শুঁটকি মাছ গারোদের প্রিয় খাদ্য। ওঁরাওদের মধ্যে পিঠা-পুলি এতটাই জনপ্রিয় যে পৌষসংক্রান্তি এবং ভাদ্র মাসের ১৩ তারিখে শুধু পিঠা তৈরি ও খাওয়ার জন্যই তারা বিশেষ অনুষ্ঠান পালন করে থাকে। পার্বত্য চট্টগ্রামের অধিকাংশ ভিন্ন নৃগোষ্ঠীর কাছে নাপ্পি বা সিঁদোল (চিংড়ি বা এ জাতীয় শুঁটকি মাছের গুড়া) অতি প্রিয়। ভাত থেকে বিশেষ প্রক্রিয়ায় তৈরি এক ধরনের পানীয় অধিকাংশ নৃগোষ্ঠীর মানুষের বিশেষ পছন্দ।

কাজ: বাংলাদেশে বিভিন্ন নৃগোষ্ঠীর সাংস্কৃতিক বৈশিষ্ট্য চিহ্নিত কর।
common.content_added_by
টপ রেটেড অ্যাপ

স্যাট অ্যাকাডেমী অ্যাপ

আমাদের অল-ইন-ওয়ান মোবাইল অ্যাপের মাধ্যমে সীমাহীন শেখার সুযোগ উপভোগ করুন।

ভিডিও
লাইভ ক্লাস
এক্সাম
ডাউনলোড করুন
Promotion